xmlns:fb='http://ogp.me/ns/fb#'> বাংলাদেশের মানুষের জন্যে বিমান ছিনতাই করেছিলেন যিনি! |Bappi

U also may b interested in these posts

 

Floadting Share

Get Widget

Monday, December 3, 2018

বাংলাদেশের মানুষের জন্যে বিমান ছিনতাই করেছিলেন যিনি!

অর্লি বিমানবন্দর, প্যারিস, ফ্রান্স, ১৯৭১। তেসরা ডিসেম্বরের উজ্জ্বল সকাল। এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে একটা সাজসাজ রব, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আজ একটু বেশীই ব্যস্ত। ধুয়েমুছে সাফ করা হচ্ছে মেঝে, আর দশটা দিনের চাইতে খানিকটা বেশীই তদারকি করছেন তারা। কারণও আছে অবশ্য, রাষ্ট্রীয় সফরে ফ্রান্সে আসছেন জার্মান ভাইস চ্যান্সেলর। দুই দেশের মধ্যে শীতল একটা অবস্থা চলছিল অনেক বছর ধরেই, সেটার পরিসমাপ্তি হয়তো ঘটবে এই সফরেই। 

বিমানবন্দরের বাইরে একটা ট্যাক্সি এসে থামলো। সেটা থেকে নামলো দীর্ঘকায় এক যুবক। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো সে। পরনে নীল জ্যাকেট, পিঠে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক। গেট দিয়ে ঢুকে সোজা ইমিগ্রেশনের দিকে এগিয়ে গেল সে। চোখে ধূর্ত চাউনি, তবে মুখটা অসম্ভব রকমের শিশুতোষ। ইমিগ্রেশনের প্রবেশপথে সিকিউরিটি চেকিঙের জন্যে থামানো হলো তাকে। এই প্রথম যুবকের চেহারায় খানিকটা ভাবান্তর দেখা গেল, তবে সেটা ক্ষণিকের জন্যে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকটা শরীর হাতড়ে খুঁজে পেলো না সন্দেহজনক কিছুই, মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়লো না জ্যা কুয়ে নামের সেই যুবকের কোমর, অন্তর্বাস আর মোজার ভেতরে গুঁজে রাখা রিভলভারের আলাদা আলাদা অংশগুলো।
রানওয়েতে পাকিস্তান ইন্টারন্যশনাল এয়ারওয়েজের একটা বোয়িং ৭২০ বিমান দাঁড়ানো, কিছুক্ষণ পরেই আকাশে উড়বে সেটা। পিআইএ-৭১১ নামের সেই বিমানে যাত্রীরা তখন ধীরেসুস্থে উঠে বসছেন, সংখ্যাটা সব মিলিয়ে ত্রিশ জনের মতো। পাইলট সবকিছু দেখেশুনে নিচ্ছেন, রুটিন মোতাবেক। সকালের মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে অর্লি এয়ারপোর্টে। ঘড়িতে সময় তখন সাড়ে এগারোটার কাঁটা অতিক্রম করেছে, এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে বিমানে উঠতে দেখা গেল আমাদের এই তরুণ, জ্যা কুয়েকে।


তবে কর্তৃপক্ষের চালাকিটা ধরতে পারেননি জ্যা কুয়ে। তাকে ধরার জন্যে ফাঁদ পেতেছিল ওরা, এজন্যেই দুই ধাপে পাঠানো হয়েছিল ঔষধের চালান, যাতে সময় পাওয়া যায়, আর প্রথম ট্রাকের সঙ্গে থাকা লোকজন বিমানের ভেতরের অবস্থাটাও দেখে আসতে পারে। বিমানবন্দর তখন ছেয়ে ফেলেছে কমান্ডোরা, তবে বিমানটা থেকে নিরাপদ দূরতে অবস্থান করছিল তারা। দ্বিতীয় ট্রাকের সঙ্গে ওয়্যারহাউজম্যানের পোষাকে এসেছিলেন কয়েকজন কমান্ডো। ট্রাক থেকে পেনিসিলিন আর পাউডার মিল্কের কার্টন বয়ে নিয়ে আসছিলেন ওরা। কার্গো ভরে গিয়েছিল, তাই বাদবাকী মালামাল এনে রাখা হচ্ছিল বিমানের মেঝেতে।
জ্যা কুয়ের খানিক অসতর্কতা কিংবা মনোযোগে চিড় ধরার অপেক্ষাতেই ছিলেন ওরা। এমনই একটা মূহুর্তে সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করলেন না তারা, হুট করেই ক্ষনিকের জন্যে অন্যমনস্ক হওয়া কুয়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কর্মীর ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ অফিসার অ্যান্টইন সিবেলো। হাতে থাকা পিস্তলটা দিয়ে সিবেলোর দিকে গুলি চালিয়েছিলেন কুয়ে, কিন্ত রিফ্লেকশান খারাপ হওয়ায় সেটা আঘাত করতে পারেনি সিবেলোকে, তার জ্যাকেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বুলেট। ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন জ্যা কুয়ে, তার ওপরে চড়াও হলো জনাপাঁচেক কমান্ডো। লাথি-কিল-ঘুষিতে বেসামাল করে ফেলা হলো তাকে।
ব্যাগের মধ্যে বোমাটোমা কিছু পাওয়া গেলো না, সেখানে ছিল পবিত্র বাইবেল, কিছু বই, একটা রেজর আর বৈদ্যুতিক তার। কুয়েকে গ্রেফতার করে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হলো গোয়েন্দা কার্যালয়ে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। সেখানে জ্যা কুয়ে অকপটে স্বীকার করলেন, পৃথিবীর বুকে নতুন একটা দেশ, বাংলাদেশের মানুষকে সাহয্য করার জন্যেই এত কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি! পরদিনের পত্রিকায় বিশাল কলাম লেখা হলো এই ঘটনা নিয়ে, কুয়ে যতক্ষণ বিমানটা দখল করে রেখেছিলেন, তখন বারবার টিভি চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল সেই দৃশ্য।
জ্যা কুয়ে যেটা করতে চেয়েছিলেন, সেটা ঠিকঠাক করতে পারেননি। তবে যে ঔষধ সামগ্রীগুলো বিমানে তোলা হয়েছিল বাংলাদেশী শরণার্থী আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্যে, সেগুলো ঠিকই বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছিল। ‘অঁদ্রে দ্য মলতে’ নামের একটি সাহায্যকারী সংস্থার মাধ্যমে সেই খাদ্রসামগ্রী ও ওষুধ যখন বাংলাদেশে পৌঁছায়, তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয় প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে বাংলাদেশ। বিমান ছিনতাইয়ের অভিযোগ প্রমাণীত হওয়ায় আদালত জ্যা কুয়েকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। তবে ১৯৭৩ সালেই জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন জ্যা কুয়ে। তার হয়ে মামলা লড়েছিলেন ঝানু সব আইনজীবি, তার আদর্শিক গুরু আঁদ্রে মার্লো স্বয়ং আদালতে হাজির হয়েছিলেন তার পক্ষে সাক্ষী দিতে!

জ্যা কুয়ে কখনও বাংলাদেশে আসেননি। যে দেশটার জন্যে তিনি জীবন বাজী রেখে এমন আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই দেশটা দেখতে কেমন, সেখানকার মানুষগুলো কেমন সেটা জানা হয়নি তার। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তিনি, হাজার মাইল দূরের একদল কালো হাড্ডিসার রুগ্ন মানুষের অসহায়ত্ব তার মনে ঝড় তুলেছিল, তিনি কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন, তিনি একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন বিশ্বজুড়ে। হয়তো তার কর্মপন্থাটা সঠিক ছিল না, কিন্ত সেই মূহুর্তে এটা ছাড়া অন্য কিছু করারও ছিল না তার। মহান এই মানুষটির এই বিশাল কীর্তির কথা আমরা মনে রাখিনি, মনে রাখাটা প্রয়োজন ভাবিনি। রক্তস্রোত পেরিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, সেটার পেছনে ভীনদেশী কত বন্ধুর কত রকমের অবদান আছে, সেসব গল্প নতুন প্রজন্মকে শোনানোর কেউ নেই, এটা তো আমাদেরই ব্যর্থতা!

অর্লি এয়ারপোর্টের রেডিও তারবার্তায় একটা মেসেজ এসেছে, সেটা খুলেই চোখ কপালে উঠলো রিসিভারের সামনে বসে থাকা অপারেটরের। পিআইএ-৭১১ বিমানটা থেকে এসেছে মেসেজ, যেটা এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে আছে রানওয়েতে। বার্তায় লেখা- “এই বিমানটা আমি ছিনতাই করেছি, আমার কথা না শুনলে পুরো বিমান উড়িয়ে দেবো আমি। আমার ব্যাগে বোমা আছে!” মজা করছে নাকি কেউ? চোখ কচলে একবার ভাবলেন অপারেটর। তারপর মেসেজটা ফরোয়ার্ড করে পাঠালেন তার উপরস্থ অফিসারের কাছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেড এলার্ট জারী করা হলো অর্লি এয়ারপোর্টে। পুলিশের গাড়ি আর দমকল কর্মীদের গাড়ির সাইরেনে তখন কান পাতা দায়!
নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ততক্ষণে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে হাইজ্যাকার জ্যা কুয়ের সঙ্গে। কি চায় সে, কেন বিমানে বোমা নিয়ে উঠেছে, কি তার উদ্দেশ্য? ওপাশ থেকে জবাব এলো, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্যে বিশ টন ঔষধ বিমানে তুলে দিতে হবে, তাহলেই কেবল মুক্তি পাবে বিমানের নিরীহ যাত্রীরা।
উত্তাল একাত্তরে, স্বাধীনতার যুদ্ধে যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর রক্তাক্ত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছে বীর বাঙালী যোদ্ধারা, কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে ভারতের মাটিতে, সেই অস্থির সময়ে ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে জ্যা কুয়ে নামের উনত্রিশ বছর বয়েসী এই তরুণ একটা পাকিস্তানী বিমান ছিনতাই করে বসেছিলেন, শুধুমাত্র কোনভাবে বাঙালির এই স্বাধীকার আন্দোলনে সাহায্য করবেন বলে! কে এই জ্যা কুয়ে? বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে তার কি সম্পর্ক?
জ্যা কুয়ের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, ১৯৪৩ সালের ৫ই জানুয়ারী, আলজেরিয়াতে। তবে জন্মস্থলে থাকা হয়নি সেভাবে, বাবা ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা, তার সঙ্গে কুয়ের পুরো পরিবার স্থায়ীভাবে বাস করা শুরু করেন ফ্রান্সে। কুয়ে আর তার এক ভাইও ফরাসী সেনাবাহিনীতে চাকুরী করতেন, কিন্ত একটা সময়ে ভালো না লাগায় সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছা-অবসর নেন জ্যা কুয়ে। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত জীবন তাকে টানতো না, তিনি উড়তে চাইতেন বাধনহারা পাখির মতো, তিনি পড়তে চাইতেন, লিখতে চাইতেন, কলমের কালিতে মনের ভাবগুলো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন।

ছোটবেলা থেকেই জ্যা কুয়ে খানিকটা একগুঁয়ে ছিলেন, যেটা ভালো বুঝতেন সেটাই করতে চাইতেন। সেনাবাহিনী ছাড়ার পরে জড়িয়ে পড়লেন একটা কট্টরপন্থী সংগঠন ওএসএস-এর সঙ্গে। এই দলটা ভাবতো, আলজেরিয়া হচ্ছে ফ্রান্সের সম্পত্তি, কাজেই আলজেরিয়াকে ফ্রান্সের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে দেয়া যাবে না কোনভাবেই। এমন সময়ে কুয়ে জানতে পারলেন ফরাসী দার্শনিক আঁদ্রে মার্লো সম্পর্কে, তার হাতে এলো মার্লের কিছু বই। তিনি শিখলেন, সাম্যবাদ কাকে বলে, উদারপন্থী নীতিটা খুবই মনে ধরলো তার। এতদিন ধরে কট্টরপন্থী মনোভাব পোষণ করে আসা কুয়ে হুট করেই উদারপন্থী হয়ে উঠলেন মার্লোর লেখা বই আর কলাম পড়ে। মার্লোকে তিনি ঈশ্বরের মতো ভক্তি করতেন।
১৯৭১ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান নামে একটা জায়গার নাম শুনলেন, যেখানকার অধিবাসীরা পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকতে চাইছে না। সেই এলাকায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ; ভাষা আর জাতীসত্ত্বায় তারা পাকিস্তানীদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবীতে আন্দোলন করছিল তারা। সেখানে জনগনের ভোটে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে কেন্দ্রীয় সরকার উল্টো সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষের ওপরে, আর সেনাবাহিনী চালাচ্ছে গণহত্যা। স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে দেশটা, চলছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। জ্যা কুয়ের আদর্শ আঁদ্রে মার্লো সেইসব স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষ নিয়েছেন, বিশ্বনেতাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও করছেন। এই ঘটনাটা মনে ভীষণ দাগ কেটে গেল জ্যা কুয়ের। কি করা যায় এই নিপীড়িত মানুষগুলোর জন্যে, ভাবতে ভাবতে রাতের ঘুম হারাম করে ফেললেন তিনি।
ঘটনায় ফিরে আসি। অনেক ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা করেই পিআইএ’র বিমান ছিনতাই করেছেন জ্যা কুয়ে। তার প্ল্যান ছিল, দাবী পূরণ হলে যাত্রীদের ছেড়ে দিয়ে পাইলট আর ক্রু’দের নিয়ে ভারতে চলে যাবেন, সেখানে শরণার্থীদের জন্যে ঔষধগুলো দিয়ে আসবেন তিনি।
বিমানের ভেতরে ততক্ষণে কেয়ামত শুরু হয়েছে, যাত্রীরা কান্নাকাটি করছেন, তারস্বরে চেঁচাচ্ছে শিশুরা। পাইলটের কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে বসে আছেন জ্যা কুয়ে। পিঠের ব্যাগটা এখন মাটিতে রাখা, সেটা থেকে উঁকি দিচ্ছে কিছু ইলেক্ট্রিক তার। সেখানে যে শক্তিশালী বোমা রাখা আছে, এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই কারো। জ্যা কুয়ে অপেক্ষা করছেন ত্রাণসামগ্রীর গাড়ি আসার। কোন আলোচনা নয়, টাকাপয়সা কিছু চাই না তার, শুধু আহত আর অসুস্থ মানুষগুলোর জন্যে ঔষধ নেবেন তিনি। জ্যা কুয়ে কোন প্রফেশনাল হাইজ্যাকার নন, বিপদে পড়া মানুষগুলোকে সাহায্য করার আর কোন উপায় না পেয়েই কাজটা করেছেন তিনি। কোন যাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেননি তিনি, সে পাকিস্তানী হলেও না।
বিকেল সোয়া পাঁচটা নাগাদ কুয়ের দাবী মেনে নিলো নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ। ঔষধে ভর্তি একটা বড় ট্রাক এসে দাঁড়ালো রানওয়েতে, বিমানের কার্গোতে তোলা হতে লাগলো সেগুলো। রেডিওতে জানানো হলো, এখানে কুয়ের চাহিদার অর্ধেকটা আছে। বাকী অর্ধেক আরেকটা ট্রাকে করে আনা হচ্ছে। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ সেই ট্রাকটাও এসে দাঁড়ালো বিমানের পাশে। প্রথম ট্রাকটা আসার পরেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আটজন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিলেন কুয়ে। নারী আর শিশুরাই অগ্রাধিকার পেয়েছিলেন এক্ষেত্রে।


তবে কর্তৃপক্ষের চালাকিটা ধরতে পারেননি জ্যা কুয়ে। তাকে ধরার জন্যে ফাঁদ পেতেছিল ওরা, এজন্যেই দুই ধাপে পাঠানো হয়েছিল ঔষধের চালান, যাতে সময় পাওয়া যায়, আর প্রথম ট্রাকের সঙ্গে থাকা লোকজন বিমানের ভেতরের অবস্থাটাও দেখে আসতে পারে। বিমানবন্দর তখন ছেয়ে ফেলেছে কমান্ডোরা, তবে বিমানটা থেকে নিরাপদ দূরতে অবস্থান করছিল তারা। দ্বিতীয় ট্রাকের সঙ্গে ওয়্যারহাউজম্যানের পোষাকে এসেছিলেন কয়েকজন কমান্ডো। ট্রাক থেকে পেনিসিলিন আর পাউডার মিল্কের কার্টন বয়ে নিয়ে আসছিলেন ওরা। কার্গো ভরে গিয়েছিল, তাই বাদবাকী মালামাল এনে রাখা হচ্ছিল বিমানের মেঝেতে।
জ্যা কুয়ের খানিক অসতর্কতা কিংবা মনোযোগে চিড় ধরার অপেক্ষাতেই ছিলেন ওরা। এমনই একটা মূহুর্তে সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করলেন না তারা, হুট করেই ক্ষনিকের জন্যে অন্যমনস্ক হওয়া কুয়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কর্মীর ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ অফিসার অ্যান্টইন সিবেলো। হাতে থাকা পিস্তলটা দিয়ে সিবেলোর দিকে গুলি চালিয়েছিলেন কুয়ে, কিন্ত রিফ্লেকশান খারাপ হওয়ায় সেটা আঘাত করতে পারেনি সিবেলোকে, তার জ্যাকেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বুলেট। ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন জ্যা কুয়ে, তার ওপরে চড়াও হলো জনাপাঁচেক কমান্ডো। লাথি-কিল-ঘুষিতে বেসামাল করে ফেলা হলো তাকে।
ব্যাগের মধ্যে বোমাটোমা কিছু পাওয়া গেলো না, সেখানে ছিল পবিত্র বাইবেল, কিছু বই, একটা রেজর আর বৈদ্যুতিক তার। কুয়েকে গ্রেফতার করে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হলো গোয়েন্দা কার্যালয়ে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। সেখানে জ্যা কুয়ে অকপটে স্বীকার করলেন, পৃথিবীর বুকে নতুন একটা দেশ, বাংলাদেশের মানুষকে সাহয্য করার জন্যেই এত কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি! পরদিনের পত্রিকায় বিশাল কলাম লেখা হলো এই ঘটনা নিয়ে, কুয়ে যতক্ষণ বিমানটা দখল করে রেখেছিলেন, তখন বারবার টিভি চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল সেই দৃশ্য।
জ্যা কুয়ে যেটা করতে চেয়েছিলেন, সেটা ঠিকঠাক করতে পারেননি। তবে যে ঔষধ সামগ্রীগুলো বিমানে তোলা হয়েছিল বাংলাদেশী শরণার্থী আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্যে, সেগুলো ঠিকই বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছিল। ‘অঁদ্রে দ্য মলতে’ নামের একটি সাহায্যকারী সংস্থার মাধ্যমে সেই খাদ্রসামগ্রী ও ওষুধ যখন বাংলাদেশে পৌঁছায়, তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয় প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে বাংলাদেশ। বিমান ছিনতাইয়ের অভিযোগ প্রমাণীত হওয়ায় আদালত জ্যা কুয়েকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। তবে ১৯৭৩ সালেই জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন জ্যা কুয়ে। তার হয়ে মামলা লড়েছিলেন ঝানু সব আইনজীবি, তার আদর্শিক গুরু আঁদ্রে মার্লো স্বয়ং আদালতে হাজির হয়েছিলেন তার পক্ষে সাক্ষী দিতে!
জ্যা কুয়ে কখনও বাংলাদেশে আসেননি। যে দেশটার জন্যে তিনি জীবন বাজী রেখে এমন আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই দেশটা দেখতে কেমন, সেখানকার মানুষগুলো কেমন সেটা জানা হয়নি তার। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তিনি, হাজার মাইল দূরের একদল কালো হাড্ডিসার রুগ্ন মানুষের অসহায়ত্ব তার মনে ঝড় তুলেছিল, তিনি কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন, তিনি একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন বিশ্বজুড়ে। হয়তো তার কর্মপন্থাটা সঠিক ছিল না, কিন্ত সেই মূহুর্তে এটা ছাড়া অন্য কিছু করারও ছিল না তার। মহান এই মানুষটির এই বিশাল কীর্তির কথা আমরা মনে রাখিনি, মনে রাখাটা প্রয়োজন ভাবিনি। রক্তস্রোত পেরিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, সেটার পেছনে ভীনদেশী কত বন্ধুর কত রকমের অবদান আছে, সেসব গল্প নতুন প্রজন্মকে শোনানোর কেউ নেই, এটা তো আমাদেরই ব্যর্থতা!
____________________________________________________________________________

Feel free to subscribe my YOUTUBE Channel and my FACEBOOK profile.

1 comment:

  1. This comment has been removed by a blog administrator.

    ReplyDelete

Receive All Free Updates Via Facebook.

Blogger Widgets..

Receive All Free Updates Via Facebook.

Receive All Free Updates Via Facebook.