_________________________________________________________________________________
এই উদ্ভাবনটা আমাদের নিজেদের; তাই আমি কথাটি সরাসরি বলতে পারি না। আমি যদি নিজে বলি, তাহলে সবাই বলতো - নিজের জিনিস তাই বাড়িয়ে বলছি । যেহেতু অন্যরা বলছে, সেহেতু আমরা এটা কোট করতে পারি। যারা এটি তৈরি করেছে তাদের মধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক আছেন, শিক্ষার্থীরা আছে, এবং তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি জিপিআইটি।
বাংলা নববর্ষের ঠিক আগের রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় বাংলা
প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা। সেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পিপীলিকা
দলের প্রধান মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আমরা এখানে তার বক্তৃতার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য
তুলে ধরলাম।
ডেইলি স্টার লিখেছে, পিপীলিকা বাংলা
নববর্ষের জন্য আমাদের একটি উপহার।
এই উদ্ভাবনটা আমাদের নিজেদের; তাই আমি কথাটি সরাসরি বলতে পারি না। আমি যদি নিজে বলি, তাহলে সবাই বলতো - নিজের জিনিস তাই বাড়িয়ে বলছি । যেহেতু অন্যরা বলছে, সেহেতু আমরা এটা কোট করতে পারি। যারা এটি তৈরি করেছে তাদের মধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক আছেন, শিক্ষার্থীরা আছে, এবং তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি জিপিআইটি।
এই দু'য়ে মিলে পুরো জিনিসটা তৈরি করে আজকের
অবস্থানে এসেছে। পৃথিবীর সবদেশেই যেমন বড় বড় কাজ হয়, সেখানে
কিন্তু বেশীর ভাগ সময় ইন্ডাস্ট্রি আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাশাপাশি কাজ করে।
কিন্তু আমাদের দেশে সেই রকম ধারনা বলতে গেলে নেই। আমরা বহু দিন ধরে চেষ্টা করছিলাম
যে আমাদের দেশের কোন বড় ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি থেকে আমরা কাজ করবো। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষকতা করেন তারা ইন্ডাস্ট্রির লোকজনকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না।
আবার ইন্ডাস্ট্রির লোকজন বলে, তোমরা
ভালোভাবে পড়াশোনা করাও না। তোমাদের ছেলেমেয়েরা ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। এই
জন্য এই দু'য়ের মধ্যে কখনো এক সাথে কাজ করা হয় নাই।
অনেক দিন থেকে কাজ করার জন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে চেষ্টা করে আসছিলাম। আমি অত্যন্ত
আনন্দিত হয়েছি যখন দেখেছি, এই প্রথমবার বাংলাদেশে
সত্যিকারভাবে কোন ভাল কাজ করার জন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডাস্ট্রি
পাশাপাশি থেকে হাতে হাত রেখে কাজ করেছেন।
এই যে আজকের পিপীলিকা বাংলা সার্চ ইঞ্জিন এটা প্রথমে শুরু
হয়েছিলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের একটি প্রজেক্ট
হিসাবে। প্রত্যেক বছরের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের একটা প্রজেক্ট করে জমা দিতে হয়।
সেই রকম একটা প্রজেক্ট ছিলো পিপীলিকা। সেই প্রজেক্ট যখন শুরু হলো তখন তারাই
প্রজেক্টটির নাম দিয়েছিলো পিপীলিকা। পিপীলিকা যেমন সব জায়গা থেকে ঘুরে ঘুরে
খাবার সংগ্রহ করে রাখে, তেমনি সার্চ ইঞ্জিনের ভিতরে সব তথ্য খুঁজে
খুঁজে রেখে দেওয়া হবে সেই ধারনা থেকে এর নাম ।
কাজেই এই সার্চ ইঞ্জিনের সাথে পিপীলিকা নামটিই উপযুক্ত।
আমাদের শিক্ষার্থীদের দেয়া নামটাই রয়ে গেছে এখনও। সেই প্রজেক্টটি এখন কিন্তু
একটা পূর্নাঙ্গ সার্চ ইঞ্জিন। আমি অহংকার করে বলতে পারি, পৃথিবীর
বড় বড় দেশের তাদের নিজের ভাষায় সার্চ ইঞ্জিন নেই। তারা বিশ্বের অন্য বড় বড়
সার্চ ইঞ্জিন গুলো ব্যবহার করে। আমরা গর্ব করে বলতে পারবো, আমাদের ভাষার জন্য আমাদের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন আছে। এটি সত্যিকার
অর্থেই একটি সার্চ ইঞ্জিন, যার মাধ্যমে সারা বিশ্বের ২০
কোটি বাঙালী তাদের নিজের ভাষার তথ্য খুঁজতে পারবে।
যখন একটি প্রজেক্ট তৈরি করতে হয়, তখন
কিন্তু অনেক গবেষণা করতে হয়। এবং এমনভাবে ডেভেলপমেন্ট করতে হবে, তখন সারা বিশ্বের থেকে এক সাথে ২০, ৩০ হাজার
থেকে ১ লাখ মানুষ এক সাথে কোন কিছু একটা তথ্য খুঁজতে যায়, তখন যেন সিস্টেমটা ক্র্যাস না করে। যারা তথ্য খুঁজতে আসে তাদেরকে সঠিক
ভাবে সাহায্য করতে হবে। অনেক টেকনিক্যালি কাজ করতে হয়। চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের
প্রজেক্ট এক জিনিস আর সত্যিকারে সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা এক জিনিস। একটি প্রজেক্ট
থেকে একটি সার্চ ইঞ্জিন কিভাবে তৈরি করতে হয়, কিভাবে কাজ
করে। সেটা করিয়ে দেখিয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীরা।
বর্তমানে বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করে আমাদের
শিক্ষার্থীরা । আমার শিক্ষার্থীরা যখন কোন কোম্পানিতে জয়েন করে, তখন আমি
তাদের জিজ্ঞেস করি, তোমার বেতন আমার বেতনের চেয়ে বেশী তো
? তারা বলে, জ্বি স্যার। তার
মানে এই তথ্য প্রযুক্তির মানুষ অনেক ভালো অবস্থানে আছে। তারা কাজ করে আমি যা বেতন
পাই তার চেয়ে বেশী বেতন পাচ্ছে।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোন বড় তহবিল নেই। আমরা
চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। জিপিআইটি আমাদের এই ছোট প্রজেক্টটি সাহায্য করে
অনেক বড় করে তৈরি করতে সাহায্য করেছে। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সব সময় আমার মনে
হয়, আমরা বাংলাদেশে অনেক বড় কাজ করতে ইচ্ছুক। এই প্রথম আমরা একটা জিনিস
তৈরি করতে পেরেছি, যা বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যে
সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিস রয়েছে সেই রকম একটি জিনিস আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা তৈরি
করেছে। আমি বলতে পারি, আমার বহু দিনের একটি শখ পূরণ
হয়েছে। আমি ধন্যবাদ জানাই আমার সহকর্মী, শিক্ষক, ল্যাব সহকারী, আমাদের শিক্ষার্থীদের।
একটা প্রশ্ন তো আসতে পারে, পৃথিবী যখন গুগলের
মতো এতো বড় একটি সার্চ ইঞ্জিন আছে, তাহলে আবার কেন
পিপীলিকা? অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন। সার্চ ইঞ্জিন থেকে
তথ্য খোঁজা এক জিনিস, আর নিজে সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করা
কিন্তু অনেক বড় বিষয়। আমি যখন সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করছি, তারা
ভিতরের সমস্ত জিনিস কিন্তু আমার জানা; আমার তৈরি করা। এটা
আমার জন্য অনেক বেশী গর্বের। এটা অনেকটা এই রকম - আমি কি গাড়ি কিনবো? না গাড়ি বানাবো? অবশ্যই আমি গাড়ি বানানো।
আমি যখন গাড়িটা কিনছি, তখন সেটা অন্য কেউ
বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি যখন গাড়িটা বানাবো, তখন এই
গাড়ির সব কিছু আমার নিজের। এটা যে কতোটা মজার তা না দেখলে বুঝা যাবে না। একটা
উদাহরণ দেই - আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচএসসি ভর্তির জন্য মোবাইল ফোন রেজিস্ট্রেশন
করার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো সারা দেশের জন্য । এর ফলে ঐ শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়ের
নাম সহ সকল তথ্য আমাদের কাছে আছে। তাদের ছবি গুলো আমাদের কাছে । এর ফলে কোন এলাকার
ছেলে মেয়ে পড়াশোনায় ভালো। কোন এলাকার শিক্ষার্থীরা অংকে ভালো এই সব তথ্যসহ সমস্ত
তথ্য আমাদের কাছে আছে। এটি তৈরি করতে গিয়ে কিছু মজার বিষয় বা তথ্য আমাদের কাছে
চলে আসে।
যেমন, বাংলাদেশে সবচেয়ে পপুলার ছেলের নাম কি?
মাসুদ রানা।
সবচেয়ে পপুলার মেয়ের নাম কি?
শারমিন।
কেউ কি জানতো? জানতো না।
সবচেয়ে পপুলার বাবার নাম কি?
আবদুল হাই। কেউ জানতো না।
সবচেয়ে পপুলার মায়ের নাম কি?
খোদেজা বেগম। এটাও কেউ জানতো না। এই সব তথ্য কিন্তু আমরা জেনে
যাচ্ছি, এটা তৈরি করার ফলে। এই বিষয়টা খুবই মজার।
তৈরি করা জন্য শুধু টেকনিক্যাল কাজ করতে হয়েছে তা নয়। এটা
তৈরি করার জন্য বাংলা ভাষার উপর কাজ করতে হয়েছে। আমি কোন কিছু একটা টাইপ করলাম।
সব সময় সেটা ঠিক ভাবে করা যাবে তেমন কথা নেই। একটা আকার বাদ পরে যেতে পারে।
বানানের ভুল টাইপ করা হতে পারে । এছাড়া নানা সমস্যা হতে পারে। সব সময় শুদ্ধ ভাবে
টাইপ করার কি নিশ্চয়তা আছে? কিন্তু পিপীলিকায় ভুল লিখলে নিজেই
সেই বানান ঠিক করে দিবে। এর ভিতরে একটা ডিকশনারি আছে। আমি যা লিখতে চেয়েছিলাম
কিন্তু লিখতে পারি নাই । সেটা বের করে দিবে পিপীলিকা।
আমার কাছে খুবই মজা লেগেছে, যখন আমি
দেখেছি আমার কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়া ছেলে মেয়েরা বসে বসে মোটা মোটা বাংলা
ব্যাকরণ বই নিয়ে পড়াশোনা করছে। আমার ধারনা তারা এখন বাংলার অনেক জ্ঞানী লোকের
চেয়ে ভালো ব্যাকরণ জানে। তার মানে বাংলা ভাষাকে সাহায্য করার জন্য শুধু কবি
সাহিত্যিকরাই না, আজকাল কিন্তু কম্পিউটার সাইন্সের
শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এখন আমরা অনেক কম পরিশ্রমে বাংলা
ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষার জন্য একটা করে দিতে পারবো।
আমি তরুণদের সাথে কাজ করতে ভালোবাসি। এবং তরুণদের সাথে কাজ
করে আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি, সেটা হলো - আমরা
বয়সে বড়, আমাদের অভিজ্ঞতা বেশী, আমরা অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু তারপরেও তরুণদেরকে তাদের মতো করে কাজ করতে
দেওয়া হলো সবচেয়ে বুদ্ধি মানের কাজ।
No comments:
Post a Comment