১৯৪৫ সালের ৬ ই
আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে জাপানের হিরোশিমা নগরীতে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম
পারমাণবিক বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটায় আমেরিকা। এর ঠিক তিন দিন পরে, ৯ই আগস্ট বেলা ১১টা ২ মিনিটে, আমেরিকা জাপানের নাগাসাকি শহরে আরো একটি পারমাণবিক বোমা
নিক্ষেপ করে। প্রথম বোমাটির নাম দেওয়া হয় ‘লিটল বয়’ বা ‘বামন বোমা’ এবং দ্বিতীয়টির
নামকরণ করা হয় ‘ফ্যাটম্যান’ বা ‘স্থুলকায় বোমা’।
লিটলবয়
* তেজস্ক্রিয় পরমাণু:
ইউরেনিয়াম-২৩৫
* ওজন : চার হাজার
কেজি
* দৈর্ঘ্য : ৯.৮৪ ফুট
* পরিধি : ২৮ ইঞ্চি
* মূল আঘাত : শিমা
সার্জিক্যাল ক্লিনিক
* বিস্ফোরণের মাত্রা:
১৩ কিলো টন টি এনটির সমান
* বহনকারী বিমানের
নাম : বি ২৯ সুপারফোর্টেস
* পাইলটের নাম :
কর্নেল পল টিবেটস
* বোমা পতনে সময় : ৫৭
সেকেন্ড
ফ্যাটম্যান
* তেজস্ক্রিয় পরমাণু:
প্লুটোনিয়াম-২৩৯
* ওজন : চার হাজার
৬৩০ কেজি
* দৈর্ঘ্য : ১০.৬ ফুট
* পরিধি : ৪ ইঞ্চি
*মূল আঘাত :
মিতসুবিসি স্টিল ও অস্ত্র কারখানা ও উরিাকামি সমরাস্ত্র কারখানার মাঝামাঝি
* বিস্ফোরণের মাত্রা:
২১ কিলো টন টি এনটির সমান
* বহনকারী বিমানের
নাম : বি ২৯ বঙ্কার
* পাইলটের নাম : মেজর
চার্লস ডবলু সুইনি
* বোমা পতনে সময় : ৪৩
সেকেন্ড
বোমা হামলার কারণে হিরোশিমা ও নাগাসাকির শহরদুটি ধ্বংসস্তুপের নগরীতে পরিণত
হয়। পারমাণবিক বোমার আক্রমণে এই দুই নগরীতে কয়েক লক্ষ মানুষ মারা যায়। ঘর-বাড়ী, গাছ-পালা, পশু-পাখি থেকে শুরু
করে জীববৈচিত্রের প্রায় সবদিকই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনো এই দুই শহরের
এবং এর পাশ্ববর্তী এলাকায় নবজাতকেরা এই নিষ্ঠুরতার, নির্মমতার মূল্য দিয়ে চলেছে। ভয়াবহ সেই বোমা হামলার স্মারক
বয়ে চলেছে এই এলাকার মানুষেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। তাই সত্তর বছর আগেকার সেই
ভয়াবহতার কথা তখনকার মানুষেরাতো বটেই,
বর্তমানযুগের মানুষেরা, এমনকি ভবিষ্যতের
মানুষেরা ভুলতে পারবে না।
এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। খুব অল্প সংখ্যকই
বেঁচে আছে। তেমনি একজন বলেছেন সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা। ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘প্রথমে মনে হল,
আকাশ থেকে যেন একটা কালো প্যারাস্যুট নেমে আসছে। পরমুহূর্তেই আকাশ যেন জ্বলে
উঠল। আলোর সেই ঝিলিক যে কী রকম তা বলার সাধ্য কারও নেই। সেই সঙ্গে প্রচ- শব্দ।
বিস্ফোরণের পরমুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগলো শত শত ভবন ও হাজার হাজার মানুষ।
সেই সঙ্গে আশপাশের জিনিসপত্র এদিক ওদিক পড়ে জমা হতে থাকল। চারিদিকে আলো ও অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। হামাগুড়ি দিয়ে বেরোতে হল, কালো ঘোর অন্ধকারে। বাতাসে বীভৎস গন্ধ। মানুষের মুখের চামড়া
যেন ঝুলে পড়েছে। কনুই থেকে আঙুল অবধি হাতের চামড়া ঝুলে পড়ছে। কাতরাতে কাতরাতে
ঝর্ণা আর নদীর দিকে ছুটে চলেছে অসংখ্য মানুষ। সারা দেহে অসহ্য জ্বালা। চারিদিকে
অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। মৃতের শরীরে কাপড়-জামা প্রায় কিছুই নেই। গায়ের
কাপড়গুলো জ্বলে গেছে। নদীর তীরের কাছে একজন নারী আকাশের দিকে মুখ করে পড়ে আছে। বুক
দুটো তার উপড়ানো, সেখান থেকে রক্ত
চুইয়ে পড়ছে। ঘণ্টা দুয়েক পর আকাশ একটু ফিকে হয়ে গেল। ঝলসে যাওয়া হাত দুটো থেকে
হলুদ কষ গড়ে পড়ছে। স্কুলের মেয়েরা কাতরাচ্ছে আর চিৎকার দিয়ে কাঁদছে মাগো মাগো বলে।
ভয়ংকরভাবে পুড়ে গেছে তারা, সারা শরীরে রক্ত
গড়াচ্ছে কাতরভাবে। মাকে ডাকতে ডাকতে একে একে দেহগুলো নিথর হয়ে যাচ্ছে।’
ব্যাপক বিধ্বংসী এই মারণাস্ত্র তৈরি করা হয় বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটি
সূত্রের উপর ভিত্তি করে। আইস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র টি হল e=mc^2। জার্মানির বিখ্যাত এনালগ ফর ফিজিক্স জার্নালে ১৯০৫ সালে
প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের এই বিখ্যাত সূত্র। একই বছর এই জার্নালে তাঁর চারটি গবেষণা
প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আইনস্টাইনের অন্য প্রবন্ধগুলোও বিজ্ঞানের ইতিহাসে ব্যাপক
যুগান্তকারী। কিন্তু e=mc^2 সূত্রের মাধ্যমেই
মানুষ জানতে পারে পদার্থের মধ্যে বিশাল শক্তির সম্ভাবনার কথা। পরমাণুর মধ্যে
প্রচুর শক্তি সঞ্চিত রয়েছে ! আইনস্টাইনের পূর্বে বিজ্ঞানীদের কাছে এ তথ্য ছিল
প্রায় অজ্ঞাত। কিন্তু আইনস্টাইন গণিতের সূত্রের সাহায্যে যখন এই সত্য উপস্থাপন
করেন তখন আর এই তত্ত্ব মেনে না নিয়ে কোন উপায় নেই। বরং এই তত্ত্ব প্রয়োগে সবাই
সচেষ্ট হতে শুরু করল। এরই ফলশ্রুতিতে তৈরি হল পারমাণবিক বোমা। শুধু তাই নয়। এই
বোমা বানানোর জন্য আইনস্টাইন স্বয়ং আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে
উৎসাহিত করেন। কিন্তু হিরোশিমা, নাগাসাকির ভয়াবহ
মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এই বোমা হামলার পর পৃথিবীর সকল বিবেকবান মানুষই ব্যথিত
ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আইনস্টাইন নিজেও ব্যথিত হয়েছিলেন। আইনস্টাইন নিজেও স্বীকার
করেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লেখা পত্রটি ছিল তাঁর জীবনের একটি মারাত্মক ভুল। এই
ভুলের মর্মপীড়ায় আইনস্টাইন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চরম মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটান। এই
কারণে অনেকে আইনস্টাইনকে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। এমনকি কিছু সংখ্যাক
বিজ্ঞানবিরোধী মানুষ এই সুযোগে বিজ্ঞানকেই মানববিধ্বংসী এই বোমার জন্য দায়ী করে
থাকেন এবং বিজ্ঞানবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে হিরোশিমা ও
নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলার জন্য কে দায়ী? বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী, নাকি লোভ, প্রতিহিংসা আর
স্বার্থ?
এনালগ ফর ফিজিক্স জার্নালে যখন তাঁর প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হয় তখন আইনস্টাইন
মাত্র ২৬ বছরের অপরিচিত, অখ্যাত এক যুবক।
কিন্তু প্রবন্ধগুলো প্রকাশের পর থেকে তিনি পৃথিবীর সকল প্রান্তের বিজ্ঞানীদের কাছে
জনপ্রিয় হতে থাকেন। ১৯১৭ সালে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশের পর আইনস্টাইন
খ্যাতির চুড়ায় উঠে পড়েন এবং ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর
আবালবৃদ্ধবণিতার নিকট আইনস্টাইন একটি অতি পরিচিত নাম হয়ে উঠতে থাকে। সকলেই
আইনস্টাইনের সঙ্গপ্রত্যাশী হয়ে উঠে। বিভিন্ন বিষয়ে আইনস্টাইনের আলোচনা, মতামত, মন্তব্য বেশ
গুরুত্ব পেতে থাকে। ক্রমে আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের গ-ি ছাড়িয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অঙ্গনেও
একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে উঠেন। কিন্তু জার্মানিতে আইনস্টাইনের ভাগ্য ততটা
সুপ্রসন্ন হল না। বিশেষ করে ১৯৩৩ সালে হিটলারের রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহনের পর থেকে
জার্মান রাষ্ট্রটিই আইনস্টাইনের নিকট হয়ে ওঠে একটি আতঙ্কের নাম। হিটলার জার্মানি
থেকে ইহুদি নিধন শুরু করে। জন্মগতভাবে আইনস্টাইন ছিল একজন ইহুদি পরিবারের সন্তান।
যদিও আইনস্টাইন ইহুদী ধর্মের অনুসারী ছিলেন না, ছিলেন না অন্য কোন ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগীও। তাঁর ধর্ম
ছিল বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ। কিন্তু তবুও কেবল জন্মের কারণেই আইনস্টাইনের উপর নানান রকমের
রাষ্ট্রী য় নিবর্তন ও খবরদারি শুরু হতে থাকে। ফলে আইনস্টাইনকে জার্মানি ছাড়তে হয়।
আইনস্টাইন পাড়ি জমান আমেরিকায়।
১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বিজ্ঞানে অগ্রাধিকার
দিতে থাকে। বিজ্ঞানের প্রতি আইনস্টাইনের এই অগ্রাধিকার মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে
ছিল না, বরং তা ছিল
সম্পূর্ণ নিজের স্বার্থে, অশুভ উদ্দেশ্যে। তা
সত্ত্বেও জার্মানি ইতোমধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞানে বেশ উন্নত হয়ে উঠে। জার্মান রসায়নবিদ
অটো হ্যান ও ফ্রিটজ স্ট্রাসম্যান পরীক্ষা করে দেখেছেন ইউরেনিয়াম-২৩৫ বিভাজিত হয়ে
প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হতে পারে। খুব অল্প সময়েই জার্মানি পরমাণু বিভাজনের প্রযুক্তি
আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়। এই পারমাণবিক বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে চেইন রিঅ্যাকশন ঘটিয়ে
মারাত্মক শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব। ১৯৩৮ সালের আগেই জার্মানি পরমাণু
বিশ্লিষ্টকরণ প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করেছে। এ বছরই বিজ্ঞানী শিলার্ড
এবং উইগনারের মাধ্যমে আইনস্টাইন জানতে পারেন যে জার্মানি পরমাণুবিশ্লিষ্টকরণ
প্রক্রিয়ার পরবর্তি ধাপ হিসেবে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রযুক্তিও অর্জন করেছে।
তাদের এই খবরের পেছনে যুক্তি ছিল জার্মানি ইতোমধ্যে ইউরেনিয়াম বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে।
জার্মানির ইউরেনিয়াম বিক্রি বন্ধের এই ঘটনাই বিজ্ঞানী মহলকে অধিকমাত্রায় আতঙ্কিত
করে তোলে। ফলে অনেকের মধ্যেই এই ধারণা প্রোথিত হয় যে জার্মানি পারমাণবিক বোমা
তৈরির প্রযুক্তি অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে বা হয়তো ইতোমধ্যেই অর্জন করে ফেলেছ।
অন্যদিকে ফ্রান্সের জুলিয়েট-কুরি বেলজিয়াম থেকে ছয় টন ইউরেনিয়াম ও নরওয়ে থেকে
প্রচুর পরিমাণ ভারী পানি সংগ্রহ করে যুক্তরাজ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এই অবস্থায়
আইনস্টাইনসহ অনেকেই আতঙ্কিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় বন্ধু
শিলার্ডের অনুরোধে আইনস্টাইন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লেখার সিন্ধান্ত নেন।
চিঠিতে রুজভেল্টকে জার্মানির পারমাণবিক বোমার প্রকল্প সম্পর্কে ধারণা দেওয়া ছাড়াও
এই বোমার শক্তি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। চিঠিতে জানানো হয় জার্মানি যদি আগে
পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হয় তবে হিটলারের সর্বগ্রাসী সা¤্রাজ্যবাদী ক্ষমতালিপ্সার
কাছে পৃথিবী তছনছ হয়ে যাবে। কারণ ইতোমধ্যে হিটলার তার বিশ্বজয়ের সর্বগ্রাসী থাবা
চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই লক্ষে ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত
হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি অস্ত্র উৎপাদন প্রায় দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং ১৯৪০
সালের জার্মান সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩৫ গুণ বৃদ্ধি করেছে।
জার্মানির একনায়ক হিটলারের বিশ্বশাসনের অমূল্যক, অবাস্তব ও অসম্ভব খায়েশ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সূত্রপাত। আর এই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় হিটলারের নাৎসী বাহিনীর পোলান্ড
আক্রমণের মধ্য দিয়ে। ১৯৩৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জার্মানি পোলান্ড আক্রমণ করে। এর
প্রতিউত্তরে মিত্রবাহিনী জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ৩রা সেপ্টেম্বর। এর
মধ্য দিয়েই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এদিকে জার্মানির আগেই জাপান প্রশান্ত
মহাসাগরীয় অঞ্চলে আগ্রাসী ও সা¤্রাজ্যবাদী আচরণ শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু অনেক
আগে থেকেই জাপান এই এলাকায় তারা আগ্রাসী দখলদারিত্ব চালিয়ে আসছিল। চীন-জাপানের চির
বৈরী সম্পর্ক আরো খারাপ হয় এবং জাপান চীনের একটি বিশাল অংশ দখল করে নেয়।
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান জার্মানির সাথে যুক্ত হয়। এ যুদ্ধে পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো
এবং অন্যান্য ছোটবড় রাষ্ট্রগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে। এর এক
দিকে জার্মান নেতৃত্বে অক্ষ শক্তি এবং অন্যদিকে আমেরিকার নেতৃত্বে মিত্র শক্তি।
অক্ষশক্তির প্রধান তিনটি রাষ্ট্র হল জার্মানি, ইতালি ও জাপান। এর অন্যান্য সঙ্গী রাষ্ট্রগুলো হলো হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া। এর সাথে যোগ দেয় ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের
কলোনিগুলো। অন্যদিকে মিত্রশক্তির রাষ্ট্রগুলো হল পোলান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইন্ডিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, মিশর, গ্রিস, যুগোস্লাভিয়া, সোভিয়েত রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, পানামা, কোস্টারিকা, ডোমিনিকান
প্রজাতন্ত্র, এল সালভাদোর, হাইতি, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, চীনা, গুয়াতেমালা, কিউবা, ফিলিপাইন, চেকোস্লাভাকিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, ইতিওপিয়া, ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, বলিভিয়া, কলাম্বিয়া, লাইবেরিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, প্যারাগুয়ে, ভেনিজুয়েলা, তুরস্ক, লেবানন, সিরিয়া, চিলি, আর্জেন্টিনা।
প্রথমদিকে আমেরিকা এই যুদ্ধ থেকে নিজেদের দূরে রাখে এবং আমেরিকার এই যুদ্ধে
অংশগ্রহণের ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আকস্মিকভাবেই ১৯৪১ সালের ৮ই ডিসেম্বর আমেরিকা
মিত্রশক্তিতে যোগ দেয়। এর আগে ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপান সম্পূর্ণ অযাচিত এবং
আকস্মিকভাবে পার্ল হারবার আক্রমণ করে। পার্ল হারবার ছিল হাওয়াই দ্বীপপূঞ্জে
অবস্থিত আমেরিকান নৌ ও বিমান ঘাটি। এ অক্রমণে প্রায় ২৪০২ জন আমেরিকান নিহত হয় এবং
আহত হয় ১২৮২ জন এর সাথে অন্যান্য ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণও ছিল বিশাল। এই আক্রমণের পরের
দিন ৮ই আগস্ট আমেরিকা জাপানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে
যুক্তরাজ্য আমেরিকাকে সাহায্য করে। ফলে জার্মানি এবং ইতালি ১১ ডিসেম্বর আমেরিকার
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর ফলশ্রুতিতে আমেরিকাও পাল্টা যুদ্ধের ঘোষণা দেয়
এবং এভাবেই আমেরিকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পরে।
জার্মানিকে হটানো কিংবা জার্মানির এই প্রচেষ্টাকে নস্যাত করার জন্য বিরোধী
পক্ষের উচিত জার্মানির আগে অথবা দ্রুতই জার্মানির চেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা
তৈরি চেষ্টা চালানো। এই ছিল আইনস্টাইনের অভিমত। তাই ১৯৩৯ সালের ২রা আগস্ট
আইনস্টাইন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি পত্র লিখেন। এই পত্রের
মাধ্যমে আইনস্টাইন প্রেসিডেন্ট রুজলেভটকে পারমাণবিক বোমা বানানোর জন্য উৎসাহিত করেন।
আইনস্টাইনের এই পত্র প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের হাতে পৌছে ১৯৩৯ সালের ১১ই অক্টোবর।
পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এই পত্র পেয়েই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ম্যানহাটন
প্রজেক্টে অর্থ ছাড়ে উৎসাহিত হয়। এই প্রজেক্টে যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স আমেরিকাকে
সহায়তা করে। ম্যানহাটন প্রজেক্টের মাধ্যমেই পরবর্তিতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে
আমেরিকা পারমাণবিক বোমা তৈরির কার্যক্রম শুরু করে। আমেরিকার বিখ্যাত
পদার্থবিজ্ঞানী ওপেন হাইমারের নেতৃত্বে ১৯৪২ সালের জুন মাসে ম্যানহাটন প্রজেক্ট
শুরু করা হয় এবং মাত্র ছয় মাসের মাথায় ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা
প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বোমার তৈরি করতে সক্ষম হয়।
আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের ফলে মিত্রশক্তি অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং
সর্বাত্মকভাবে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। প্রথমদিকে অক্ষশক্তি অনেক
শক্তিশালী হলেও পরবর্তিতে, বিশেষ করে ১৯৪৪ সালের
পর, মিত্রশক্তি ক্রমেই
অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। অন্যদিকে অক্ষশক্তির বিবদমান দেশগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অক্ষবাহিনীর পরাজয় সুনিশ্চিত হতে থাকে। যুদ্ধ জয়ের প্রাক্কালে
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মাত্র ৬২ বছর বয়সে,
১৯৪৪ সালের ১২ই এপ্রিল, মৃত্যুবরণ করায়
আমেরিকায় নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় ট্রুম্যান। রুজভেল্ট এর মৃত্যুর মাত্র
একমাসের মাথায় ১৯৪৫ সালের ৮ ই মে জার্মানি আত্মসমর্পন করে। জার্মানির আত্মসমর্পনের
পর অক্ষশক্তির অন্যান্য দেশগুলোর মনোবল ভেঙ্গে পড়তে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা
থেকে অক্ষশক্তির পশ্চাদপসারণ ও পরাজয়ের খবর আসতে থাকে। এমতাবস্থায় মিত্রশক্তির জয়
অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। কিন্তু এরই মধ্যে আমেরিকা ১৯৪৫ সালের ১৬ শে জুলাই নিউ
ম্যাক্সিকোর আলামোগোরডো এলাকার কাছে পরমাণু পরীক্ষা চালায়। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম
পারমাণবিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষা সফল হওয়ায় আমেরিকার নেতৃত্ব চার বছর আগে জাপানের
পার্ল হারবার আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ পায়। ১৯৪৫ সালের ২৬ শে জুলাই
মিত্রপক্ষ জাপানের প্রতি তাৎক্ষণিক বিনাশর্তে আত্মসমর্পনের দাবি জানায় এবং এর ঠিক
দশ দিন এবং তের দিনের মাথায় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা
হামলা চালায় আমেরিকা। এবং অবশেষে ১৯৪৫ সালের ১৫ ই আগস্ট জাপান আত্মসমর্পন করে। এর
অল্প কয়েকদিন পরেই, ১৯৪৫ সালের ২ রা
সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পরিসামপ্তি ঘটে।
১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছর মেয়াদী এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় দশ
কোটির অধিক সামরিক ও বেসামরিক লোক নিহত হয়,
আহত হয় অগণিত। আর এই যুদ্ধে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। এই বিশ্বযুদ্ধের
কারণ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যতই মতভেদ থাকুক না কেন এ বিষয়ে সকলেই একমত হবেন যে
সীমাহীন লোভ, সা¤্রাজ্যবাদীতা, গোয়ারতুমিতা, অহমই ছিল এই
যুদ্ধের মূল কারণ। কেবল এই যুদ্ধই নয়,
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় সকল যুদ্ধই হয়েছে এইসকল কারণে।
সা¤্রাজ্যবাদ ও দখলদারিত্বের জন্য, সীমাহীন লোভের জন্য,
পৃথিবী শাসনের অমূলক বাসনার জন্য এমনটি বিশ্বযুদ্ধ শুরুর জন্য হিটলার পৃথিবীর
নিকট নিন্দার পাত্র। একইভাবে যুদ্ধে জয় সুনিশ্চিত জেনেও আমেরিকা জাপানে বোমা হামলা
চালানোর সিদ্ধান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে পরিগণিত হয়ে
থাকবে। হয়তো এর জন্য ভবিষ্যতে আমেরিকাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতেও পারে। আজকের
বিবেকবান মানুষেরা এবং আগামীদিনের মানুষেরা সা¤্রাজ্যবাদী, লোভী, প্রতিহিংসাপরায়ন
কোন অহংকারী শাসক, গোষ্ঠি এবং
রাষ্ট্রকেই মেনে নেবে না।
Thanks...
====>
Always feel free to SHARE so
that your friends can can know these informations.
Don’t
forget to vote for this blog and also feel free to rate the posts.
U
also can submit your email to SUBSCRIBE this blog.
♥
♥
Thanks
again. :)
No comments:
Post a Comment